এইমাত্র আমার জন্ম হয়েছে। ভোরের আলো মাত্র ফুটতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ আগে কেউ একজন আমাকে এখানে ফেলে গিয়েছে। যে আমাকে এখানে রেখে গেছে সে অনেকক্ষণ আমাকে তার দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো। আমিও পরম শান্তিতে তার বুকে নিজের অস্তিত্ব, শান্তি, সুখ খোঁজার চেষ্টা করছিলাম।
কিন্তু না, আমার সুখটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নি। ক্ষণিকের সুখে যখন আমি আচ্ছন্ন, মোহগ্রস্ত ঠিক তখনি খেয়াল করলাম আমি একটা দূর্গন্ধময় ঘরের মধ্যে পড়ে আছি। জায়গাটা অনেকটা চারকোণা, শক্ত কিছু একটা দিয়ে ঘেরা দেওয়া। জায়গাটা থেকে প্রচন্ড দূর্গন্ধ ছুটছে। বিভিন্ন গন্ধ আমার নাকে এসে লাগছিল।
ইতোমধ্যে ভোরের আলো সকালের আলোয় রুপ নিয়েছে। এরই মধ্যে আমি বুঝে গিয়েছি, যে গ্রহে আমি জন্মলাভ করেছি তা মোটেও আমার জন্যে সুখকর কোনো স্থান নয়।
কিছুক্ষণ আগে লম্বা পাতলাদেহি কেউ একজন এসে এক পলিথিন আবর্জনা ফেলে গিয়েছে। দূর থেকে কয়েকটা কাক উড়ে এসে সেই পলিথিন থেকে কি যেন খুটে খুটে খাচ্ছিলো। একটা কাক বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এই বুঝি ঠোকর মারে। কিন্তু না, খেয়াল করলাম কাকটির চোখে কোনো হিংস্রতা ছিলো না । দুটি মায়াভরা আবেগময় চোখ তাকিয়ে ছিলো যেন আমার দিকে। শেষ পর্যন্ত কাকটা ঠোকর মারে নি। কেন মারে নি তাও জানি না। হয়ত মায়া লেগেছিলো। এরই মধ্যে একটা কাক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো,
-‘কে তুমি ভাই?’
আমি শুধু বলেছিলাম, ‘ আমি জানি না।’
আমি তো সত্যিই জানি না আমি কে? কাকটা আর কিছু না বলেই নির্বিকার ভঙ্গিতে চলে গিয়েছিলো। এটা হয়ত তার কাছে নিত্যদিনের কোনো ঘটনা ছিলো। কিন্তু কাকটা আমাকে ভাই ডেকেছিলো কেন তা জানি না। হয়ত নিজের গোত্রের কেউ মনে করেছিলো।
দেখতে পেলাম দূর থেকে কয়েকটা ছোট বাচ্চা জুসের প্যাকেট হাতে আসছিলো। এর মধ্যে একটা বাচ্চা একটা জুসের প্যাকেট আমার এই চারকোণা দূর্গন্ধময় ঘরটায় ছুড়ে মারলো। আমার গায়ে পরতে পরতেও পরলো না। সেই অর্ধ-খাওয়া জুসের প্যাকেট থেকে ছিটকে আসা কয়েক ফোটা জুস আমার মুখে এসে পরলো। এই কঠিন পৃথিবীতে এই প্রথম আমি কোনোকিছুর স্বাদ আস্বাদন করলাম। এ যেন অমৃত।
দেখতে পেলাম কয়েকটি শীর্ণদেহি ছেলে আসলো। তাদের গায়ের চামড়াগুলো রোদে পুড়ে কালো হয়ে গেছে। এদের পরনে ছিলো যৎসামান্য বস্ত্র। মুখগুলো শুকিয়ে গেছে, পাজরের হাড়গুলো স্পষ্ট। তারা উদভ্রান্তের মত কি যেন খুঁজছিল। কি যেন পেয়ে তাদের ক্ষুধার্ত চোখ চকচক করে উঠলো। অর্ধ খাওয়া এক ফালটি তরমুজ পেয়েছিলো তারা। সেটাই খেতে লাগলো অনেক আয়েশ করে। কিছুক্ষণ পর তারাও চলে গেলো। আমাকে দেখতে পেলো না। হয়ত দেখেছে কিংবা দেখেনি। কিংবা দেখেও না দেখার ভান করেছে। কারণ- এই দুনিয়া তাদের শিখিয়েছে, যেখানে নিজের অন্ন-বস্ত্র নাই সেখানে উটকো ঝামেলায় কে জড়াতে চাইবে।
ঠাওর করতে পারছিলাম না কতক্ষণ কেটে গেছে...
আমি এখন সিটি কর্পোরেশনের গাড়ির উপরে। কয়েকজন লোক এসে সেই চারকোণা ঘরটা একেবারে উপুড় করে এই গাড়ির মধ্যে ঢেলে দিয়েছে। তারাও আমাকে দেখতে পায়নি। আমি এখন সেই গাড়ির উপরে। কিছুক্ষণ পর গাড়ি থামলো। সব আবর্জনা গুলো এক জায়গায় ফেলে দেওয়া হলো। সাথে আমিও পড়ে গেলাম। মনে হলো কোনো আবর্জনার ফ্যাক্টরিতে এসে পরলাম। আমি তাকিয়ে আছি। উপরে খোলা আকাশ, মাথার উপরে তপ্ত সূর্য, খোলা আকাশে কালো কাক গুলো কাকা শব্দে আকাশটাকে চিড়ে ফেলবে মনে হয়। না, আমি আর পারলাম না। জ্ঞান হারালাম।
পরে জানতে পেরেছিলাম কয়েকজন টোকাই আমাকে কুড়ে এনেছিলো। আমি এখন তাদেরই একটা অংশ। সারাদিন ওদের সাথেই থাকি, খাই, গল্প করি; ওদের নিয়েই স্বপ্ন দেখি।
কেউ কেউ আমাকে বাস্টার্ড বলে। বলতে পারেন, ‘আমার দোষটা কোথায়?’
নয়ন ছেলেটা হড়হড় করে সব বলে গেলো। সাথে দু'ফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো।
সে হাঁটা ধরেছে। তার গন্তব্য ঐ চারকোণা ঘেরা দেওয়া দূর্গন্ধময় ঘরটি। যেখানে হারিয়েছে সে তার ‘সত্তা’ কে । হাজারো নয়নরা প্রতিনিয়ত হারিয়ে খুঁজে ফিরে তাদের ' সত্তা ' কে। আমরা যে সত্তার নাম দিয়েছি বাস্টার্ড!
(একটি কল্প-বাস্তবিক ভাবনা)
- শাকিল আব্দুল্লাহ (Shakil Abdullah)
0 Comments